শঙ্খপাড়ের বার্মা কলোনিতে ১০ সহস্রাধিক রোহিঙ্গার আবাস

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কের দোহাজারী ব্রিজের দক্ষিণ পাশ থেকে নদীর পাড় ঘেঁষে পশ্চিম পাশে গড়ে উঠেছে বিশাল বস্তি। যাকে বার্মা কলোনি বা রোহিঙ্গা বস্তি বলে সবাই চিনে। এই বস্তিতে প্রায় ৩ হাজারের বেশি রোহিঙ্গার বসবাস। এক সময় এই সংখ্যা দ্বিগুণ ছিল। তাদের একটা অংশ কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে ফেরত গেলেও অনেকেই স্থানীয়দের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে বলে জানাচ্ছেন স্থানীয়রা।

কলোনিতে আছে রোহিঙ্গাদের বেশ কিছু দোকান। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও দোকান পরিচালনা করেন। অলস বিকেলে দোকানগুলো ভরপুর থাকে রোহিঙ্গা পুরুষদের আড্ডায়।

ষাটোর্ধ রোহিঙ্গা নাগরিক মো. ইউনুছ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে জানালেন, ২৫ থেকে ২৬ বছর আগে তিনি মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে এসেছেন। কোরআনে হাফেজ ইউনুছের দুই ছেলেও কোরআনে হাফেজ। দুজনই ঢাকায় চাকরি করেন। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন আরেক রোহিঙ্গা যুবকের সাথে। মেয়ের স্বামীর পরিবার টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থাকেন।

রোহিঙ্গা নারী শামসুন নাহার জানালেন, বয়সের ভারে তার স্বামী এখন কিছু করতে পারেন না। দুই ছেলে দিনমজুরের কাজ করে। ‘এ দেশেত আসছি সাত-আস্ট বছর হবে’—জানালেন তিনি। আগ থেকে যারা এখানে ছিল তাদের মাধ্যমেই কক্সবাজার পাড়ি দিয়ে বার্মা কলোনিতে স্থান হয় তাদের। বার্মা কলোনিতে আসার আগে কিছু দিন হ্নীলায় তারা অবস্থান করেছিলেন বলেও জানান তিনি।

২০ থেকে ২২ বছরের যুবক সেলিম বলেন, ‘আমার জন্ম এখানে। ক্ষেতে কামলার কাজ করি, সুইপারের কাজ করি। পেলাস্টিক (প্লাস্টিক), ভাঙ্গা-চোরা মালামাল নিয়ে আসি, বেচি।’

কলোনির ভিতরে সরেজমিনে দেখা যায়, শিশুরা দলবদ্ধভাবে খেলছে। তাদের একটি দলের নেতা করিম। করিমের পিতাও সুইপার। করিম জানায় ‘মুক্তি ইসকুলত পরি’। তার দেখানো পথে এগিয়ে গিয়ে দেখা যায়, ‘পশ্চিম কাটগড় মুক্তি স্কুল’ নামে একটি স্কুল আছে। যা বাস্তবায়ন করেছে ‘মুক্তি কক্সবাজার’ এনজিও।

পেশায় পিকআপ চালক স্থানীয় বাসিন্দা আহমাদুর রহমান বলেন, ‘শঙ্খপাড়ের দুই বার্মা কলোনিতে দশ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা আবাস গড়েছে। এতে আমাদের নানান অসুবিধা হচ্ছে। প্রথমত আমাদের কর্মসংস্থানে সমস্যা হচ্ছে। স্থানীয় দিনমজুররা অনেকটা কর্মহীন। দ্বিতীয়ত কলোনিতে ইয়াবা বেচাবিক্রির পাশাপাশি অসামাজিক কর্মকাণ্ডও চলে। এতে এলাকার যুবকদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা শঙ্কিত। তাই তাদের ক্যাম্পে ফেরত না নিলে আমরা বড় সংকটে পড়বো।’

একাধিক ব্যক্তির কথায় উঠে আসে কলোনিতে অসামাজিক কার্যকলাপের সব খবর থাকে সবজিব্যাপারি জাফর সওদাগরের কাছে। জাফরের দোকানে গিয়ে তার সাথে আলাপ করলে প্রথমে কিছুই জানে না বলে জানান। পরে স্বীকার করলেন কিছু কিছু ঘটে। এতটুকু বলে তিনি টয়লেটে যাওয়ার কথা বলে প্রায় একঘন্টায়ও দোকানে ফিরে আসেননি। তার রহস্যজনক চলে যাওয়াটা পরিস্কার হয়েছে সূর্য অস্ত যাওয়ার সাথে সাথেই। অপরিচিত যুবকদের আনাগোনা বাড়ার পাশাপাশি কলোনির ঘরগুলোর বাইরে সাজগোজ করা তরুণীদেরও আনাগোনা শুরু হয়।

কলোনিতে ঘর তৈরি করে ভাড়া দিয়েছেন হাসান আলী। তিনি কেরানিহাট ফাজিল মাদরাসায় শিক্ষকতা করেন। হাসান আলী জানান, তার ২০টি ঘরে রোহিঙ্গারা ভাড়া থাকতো। চলতি বছরের বন্যায় ঘরগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় এখন ছয়টি পরিবার আছে। বাকিরা অন্যত্র চলে গেছে।

হাসান আলী আরো জানান, ১৯৯২ সালের পর থেকে শঙ্খ নদীর দুই পাড়ে রোহিঙ্গারা আবাস গড়ছে। শঙ্খের উত্তর পাড়ের অংশ চন্দনাইশ, দক্ষিণ পাড়ের অংশ সাতকানিয়া। দুই পাড়ের দুই কলোনিতে ৫ শতাধিক পরিবারের বসবাস। সরকার যে সিদ্ধান্ত দেবে আমরা এলাকাবাসী সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সরকারকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছি।

এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াছ হোসেন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের যাতে ভোটার তালিকাভুক্ত করা না হয় সেজন্য আমরা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সতর্ক করেছি। সচেতনতা সৃষ্টির জন্য মাইকিং করেছি। বেশ কিছু রোহিঙ্গা চিহ্নিত হওয়ার পর আমরা তাদের কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ফেরতও পাঠিয়েছি। চন্দনাইশ ও সাতকানিয়া বা জেলার অন্যান্য জায়গায় যদি রোহিঙ্গা থাকে তদন্তসাপেক্ষে সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী আমরা পদক্ষেপ গ্রহণ করবো।

প্রতিবেদনটি চট্টগ্রাম প্রতিদিনে প্রকাশিত হয়েছে

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *